All news

বসুন্ধরা গ্রুপের সহায়তা পেয়ে আত্মপ্রত্যয়ী নারীরা

বসুন্ধরা গ্রুপের সহায়তা পেয়ে আত্মপ্রত্যয়ী নারীরা

প্রচণ্ড দাবদাহ চলছে। গাছগাছালি ঘেরা অঞ্চলগুলোতে একটু বাতাস পাওয়া গেলেও চর এলাকার মানুষ গরমে অস্থির। এত গরমেও বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে যমুনা নদীর ভাঙনকবলিত এলাকার মানুষের মাঝে স্বস্তির ছোঁয়া এনে দিল বসুন্ধরা গ্রুপ। প্রত্যেকের চোখেমুখে লেগে ছিল আনন্দের ঝিলিক।

এর কারণ, শুভসংঘ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মাধ্যমে অসচ্ছল ১০ নারীকে সেলাইয়ের কাজ শেখানো হয়েছে। সেই নারীদের প্রত্যেককে স্বাবলম্বী করতে বসুন্ধরা গ্রুপের পক্ষ থেকে সেলাই মেশিন দেওয়া হচ্ছে। তাঁদের হাতে সেলাই মেশিন তুলে দিতে ঢাকা থেকে এসেছেন বরেণ্য কথাসাহিত্যিক ও কালের কণ্ঠ’র প্রধান সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন।

সম্প্রতি বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে গ্রামীণ অসচ্ছল ১০ নারীর হাতে বসুন্ধরা গ্রুপের পক্ষ থেকে সেলাই মেশিন তুলে দেওয়া হয়েছে।

সেখানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ইমদাদুল হক মিলন বলেন, ‘বসুন্ধরা গ্রুপের সহায়তায় গ্রামীণ অসচ্ছল নারীদের স্বাবলম্বী করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় এবং সম্ভব হলে প্রতিটি উপজেলায় প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে তুলতে নির্দেশ দিয়েছেন। সারিয়াকান্দিতে শুভসংঘ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়েছে প্রায় দুই মাস আগে। এখানে যে ১০ জন নারী প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, তাঁদের প্রত্যেককে বসুন্ধরা গ্রুপের সহায়তায় উপহার হিসেবে সেলাই মেশিন বিতরণ করা হলো।

তাঁরা এটি দিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াবেন এবং পরিবারে সচ্ছলতা আনবেন। দেশের সবচেয়ে বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা গ্রুপের চাওয়া-পাওয়ার কোনো কিছু নেই। একটিই চাওয়া, সেটি হলো শিক্ষার্থীরা শিক্ষাবঞ্চিত না হোক, নারীরা স্বাবলম্বী হোক, মানুষের মাঝে সচ্ছলতা ফিরে আসুক। এই চাওয়া থেকেই আমরা শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দিচ্ছি; স্কুল, পাঠাগার ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র করে দিচ্ছি। উত্তরাঞ্চল দিয়ে এই কাজ শুরু হয়েছে।

এই অঞ্চলেই শতাধিক স্কুল, প্রশিক্ষণকেন্দ্র ও পাঠাগার করার পরিকল্পনা রয়েছে। এরপর দেশের অন্যান্য এলাকায় এই কাজ বিস্তৃত হবে।’

শুভসংঘ সারিয়াকান্দি উপজেলা শাখার সভাপতি সুজিত সাগরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন সারিয়াকান্দি পৌর মেয়র মতিউর রহমান মতি, সারিয়াকান্দি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রাজেশ কুমার চক্রবর্তী, সারিয়াকান্দি সদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আব্দুল কাফি মণ্ডল, শুভসংঘের পরিচালক জাকারিয়া জামান, সহসভাপতি লিমন বাশার, বগুড়া শুভসংঘের উপদেষ্টা মোস্তফা মাহমুদ শাওন ও বাংলাদেশ প্রতিদিনের সিনিয়র রিপোর্টার আব্দুর রহমান টুলু।

মতিউর রহমান মতি বলেন, ‘পশ্চাৎপদ এই এলাকার মানুষের পাশে দাঁড়ানোর যে উদ্যোগ বসুন্ধরা গ্রুপ নিয়েছে, তা সত্যি প্রশংসার। একদিকে যমুনা, অন্যদিকে বাঙ্গালী নদীর ভাঙনের শিকার পুরো উপজেলা। এ কারণে এই উপজেলায় দরিদ্র ও অসহায় মানুষের সংখ্যা বেশি। এসব মানুষকে আর্থিকভাবে সচ্ছল করার উদ্যোগ নেওয়ার জন্য বসুন্ধরা গ্রুপ ও শুভসংঘের প্রতি কৃতজ্ঞতা।’ সারিয়াকান্দি উপজেলার বোহাইল ইউনিয়নের দুর্গম চর ধারাবর্ষায় একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপনের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ওই চরের পাঁচ কিলোমিটার এলাকায় কোনো উচ্চ বিদ্যালয় নেই। সেখানে একটি উচ্চ বিদ্যালয় করা গেলে সেখানকার শিশুদের মাধ্যমিক শিক্ষা পেতে সহায়ক হবে।’

সারিয়াকান্দি থানার ওসি রাজেশ কুমার চক্রবর্তী বলেন, ‘নদীভাঙনের কারণে সারিয়াকান্দি উপজেলার বিপুলসংখ্যক মানুষ তাদের সর্বস্ব হারিয়েছে। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বসুন্ধরা গ্রুপের মতো শিল্পপ্রতিষ্ঠান এগিয়ে এলে এই এলাকার মানুষের দরিদ্রতা লাঘব হবে। নারীদের কর্মসংস্থানে উদ্যোগ নেওয়ায় বসুন্ধরা গ্রুপকে ধন্যবাদ জানাই।’

যাঁদের জন্য এই আয়োজন, সেই ১০ নারী বিনা মূল্যে সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়ে বসুন্ধরা গ্রুপের সেলাই মেশিন উপহার পেয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। তাঁরা বসুন্ধরা গ্রুপ ও শুভসংঘের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তামান্না-ই আক্তার বলেন, ‘আমরা নদীভাঙা এলাকার লোক। নদীত সব চলে গেছে। এভাবে আমাদের মতো অসহায়দের পাশে যে বসুন্ধরা গ্রুপ দাঁড়াবে, সেটা ভাবতেই পারিনি। তাদের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। এই এলাকায় আরো যাঁরা এমন অসহায় নারী আছেন, তাঁরাও যেন নিশ্চিন্তে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেন, সেই উদ্যোগ নেওয়ার অনুরোধ জানাই।’ দুই কন্যার জননী তামান্না জানান, নদীভাঙনের কারণে তাঁদের সবই গেছে। স্থানীয় এক এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে স্বামী কিছু করার চেষ্টা করছিলেন। সেই টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে এখন দিনমজুরি করছেন তাঁর স্বামী শাকিল। যা উপার্জন হয়, তার বেশির ভাগ চলে যায় ঋণের কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে। ফলে দুই মেয়ের লেখাপড়া চালানো কষ্টকর হয়ে পড়ে। এরই মাঝে তিনি জানতে পারেন, কালের কণ্ঠ শুভসংঘ থেকে ফ্রি সেলাই প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। সেখানে তিনি ভর্তি হন। প্রশিক্ষণ দেওয়ার পর সেলাই মেশিনও উপহার দেবে, এটি জানতেন না তামান্না। সেলাই মেশিন উপহার পেয়ে তিনি এখন খুব খুশি। এবার সেলাইয়ের কাজ করে অর্থ উপার্জন করতে পারবেন বলে জানান তামান্না।

শুভসংঘ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আরেক প্রশিক্ষণার্থী বাকপ্রতিবন্ধী বেদেনা আক্তার। ২৫ বছর বয়সী বেদেনার বাবা একজন দিনমজুর। নদীভাঙনের কবলে পড়ে নিঃস্ব হয়েছেন তাঁরা। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধে একটি ছাপরাঘর বানিয়ে সেখানে কোনো রকমে দিন যাপন করছেন। প্রতিবন্ধী হওয়ায় বেদেনার বিয়ে হয়নি। সারা জীবন তাঁকে মা-বাবার সংসারে বোঝা হয়ে থাকতে হবে—এই ভাবনায় সব সময়ই মন খারাপ থাকত তাঁর। এখন তিনি স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। কথা বলতে না পারলেও উচ্ছ্বসিত বেদেনা ইশারায় জানান, প্রশিক্ষণ শেষে সেলাই মেশিন পেয়ে নিজের ও পরিবারের ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে পারবেন তিনি। আরেক প্রশিক্ষণার্থী শাকিলা বেগম জানান, নবম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই বিয়ে হয় তাঁর। দরিদ্র বাবা সংসারের ব্যয় কমাতে বিয়ে দেন। বিয়ের পর পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। বেকার স্বামীর চাকরির আশায় কয়েক বছর ঢাকায়ও বসবাস করেছেন। ঢাকায় গিয়ে কোনো চাকরি তো জোটেইনি, ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। সেখান থেকে বাড়িতে ফিরে অন্যের জমি বর্গা নিয়ে কৃষিকাজ শুরু করেন তাঁর স্বামী। বড় মেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে, ছেলের বয়স এক বছর। দুই সন্তান নিয়ে সংসার চালানো এবং ঋণ পরিশোধ প্রায় অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। সংসারে সচ্ছলতা আনতেই তিনি শুভসংঘ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সেলাই প্রশিক্ষণ নিতে যান। প্রশিক্ষণ শেষে বিনা মূল্যে সেলাই মেশিন পেয়ে সচ্ছল সংসার গড়ার স্বপ্ন দেখছেন শাকিলা।

নাজু খাতুন স্বামীর সঙ্গে দীর্ঘদিন ঢাকায় গার্মেন্টে কাজ করেছেন, কিন্তু সেলাইয়ের কোনো কাজ করা হয়নি তাঁর। প্যাকেজিংয়ের কাজ করতেন। হঠাৎই তাঁদের কাজ থেকে বাদ দেওয়া হয়। বাধ্য হয়ে গ্রামের বাড়ি ফিরে আসেন তাঁরা। সাত বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে চরম অর্থকষ্টে পড়েন নাজু ও তাঁর স্বামী সিদ্দিকুর রহমান। সংসার চালাতে তাঁর স্বামী বেছে নেন দিনমজুরির কাজ। আগে দুজনের উপার্জনে সংসার চলত। এখন একাই সিদ্দিককে কাজ করতে হচ্ছে। নাজুর হাতে কোনো কাজ নেই। শুভসংঘের সেলাই প্রশিক্ষণের বিষয়টি জানতে পেরে সেখানে যুক্ত হন নাজু। দুই মাস প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষে বসুন্ধরা গ্রুপের সেলাই মেশিন হাতে পেয়ে খুশি তিনি। এখন স্বপ্ন বুনছেন সুখী সংসারের।

কৃষক বাবার সন্তান কাইফা আক্তার কাজল। স্থানীয় উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। নদীভাঙন কবলিত সারিয়াকান্দি উপজেলায় কৃষিকাজ বলতে মৌসুমি কাজ। কাজ না থাকলে চরম সংকট দেখা দেয় সংসারে। এ কারণে লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয় কাজলের। কিন্তু লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার অদম্য ইচ্ছার কারণে নিজেই কিছু করার সিদ্ধান্ত নেয় সে। নিজের খরচ জোগাতে যোগ দেয় শুভসংঘের সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। সেলাইয়ের কাজ শেখার পাশাপাশি ফ্রি সেলাই মেশিন পাওয়ায় এখন আর লেখাপড়া নিয়ে সংকটে পড়তে হবে না কাজলকে। ১৯৯৩ সালে যমুনা নদীর ভাঙনে ভিটামাটি হারায় সাহেনা বেগমের পরিবার। সব কিছু হারিয়ে আশ্রয় নেয় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে। সংসার চালাতে এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে সাহেনার স্বামী কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেছিলেন। তিন বছর আগে হঠাৎই মারা যান তাঁর স্বামী। সংসারের উপার্জন একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। অর্থাভাবে একমাত্র ছেলের পড়ালেখাও বন্ধ করে দিতে হয়। অন্যের সাহায্য-সহযোগিতায় কোনো রকমে জীবনধারণ করছিলেন তাঁরা। সেই সাহেনা এখন শুভসংঘ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সেলাইয়ের কাজ শিখছেন। বসুন্ধরা গ্রুপের সহায়তায় বিনা মূল্যে সেলাই মেশিন পেয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন তিনি।

উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী মুক্তি আক্তার। পাঁচ বছর বয়সে মা-বাবার বিবাহবিচ্ছেদ হয়। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। সত্মায়ের সংসারে টিকতে না পেরে মুক্তির ঠাঁই হয় দিনমজুর দাদার সংসারে। চেষ্টা করেও মায়ের আর কোনো খোঁজ পায়নি সে। অভাবের মাঝেও দাদা অনেক কষ্টে তাকে পড়ালেখা করিয়েছেন। বার্ধক্যজনিত কারণে এখন শয্যাশায়ী মুক্তির দাদা। নিজেদের জমি বলতে কিছুই নেই। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের জমিতে থাকে। কলেজে ভর্তি হওয়ার কিছুদিন পরেই অর্থাভাবে মুক্তির পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। সংসার চালানোর দায়িত্বভার তার ওপর এসে পড়ে। অসুস্থ দাদার চিকিৎসা ও সংসারের খরচ চালানোর কোনো উপায় পাচ্ছিল না মুক্তি। শুভসংঘের বিনা মূল্যে সেলাই প্রশিক্ষণ আর বসুন্ধরা গ্রুপের সহায়তায় সেলাই মেশিন পেয়ে এখন অনেকটাই আত্মপ্রত্যয়ী মুক্তি।

SOURCE : কালের কণ্ঠ