৮ উইকেটকে ছাপিয়ে এক বাউন্ডারি!

সংবাদ সম্মেলন শেষে চেয়ার ছেড়ে উঠতে গিয়েও বসে পড়লেন মুশফিকুর রহিম। তরুণ এক সতীর্থকে আগলে রাখার জন্য তাঁর মরিয়া চেষ্টায় একটু আগেই শোনা ‘হিরো’ শব্দটার যোগসূত্র আছে সম্ভবত। এমনিতেই মৃদুভাষী তাইজুল ইসলাম অধিনায়কের পাশে বসে এত নিচু স্বরে কথা বলছিলেন যে মাইক্রোফোনেরও সাধ্য ছিল না তা সবার কানে পৌঁছে দেয়! তাই বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাস-সেরা বোলিংয়ে ম্যাচসেরার পুরস্কার জিতে নেওয়া এই বাঁহাতি স্পিনারকে একটু জোরে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানাতে অনুরোধ করলেন কেউ কেউ। তখনই কারো কারো প্রশ্নে বোধ হয় অতিরঞ্জনও খুঁজে পেলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক।
তাই একটা অনুরোধ রাখলেন তিনি, ‘এরকম পারফরম্যান্স বাংলাদেশ দলে অনেকেই করে থাকে। ও যেটা করেছে, আশা করি ভবিষ্যতেও করবে। ওর মতো তরুণ ক্রিকেটার ভালো করলে আপনারা এমন কিছু করবেন না যাতে ওরা নিজেকে আরো অনেক বড় ভাবতে শুরু করে। বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক হিসেবে এটা আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ। আমাদের পারফর্ম করতে হবে, এটাই তো স্বাভাবিক। রান করা এবং উইকেট নেওয়ার জন্যই কিন্তু আমরা পারিশ্রমিক পাই।’ প্রচারমাধ্যমের আগ্রহের চোখ সরাতেই তাইজুলকে আড়াল করার চেষ্টা অধিনায়কের।
যদিও মেঘের আড়ালে লুকাতে থাকা বাংলাদেশের জয়ের সূর্য যে আবার উঁকি দিয়ে শেষ পর্যন্ত সোনারোদে ভাসল, তাতে ব্যাট হাতে মুশফিকের সঙ্গে এই তাইজুলেরও অবদান আছে। যখন উইকেটে যান, তখন ৮২ রানে ৭ উইকেট হারিয়ে থরথর করে কাঁপছে বাংলাদেশ। জিততে তখনো আরো ১৯ রান চাই। অধিনায়কের সঙ্গে জুটিতে প্রয়োজনীয় রান এনে দেওয়া তাইজুল ২৩ বল খেলে করলেন অপরাজিত ১৫। এর মধ্যে দু-দুটি বাউন্ডারিও আছে। যার শেষটি (এলটন চিগুম্বুরার শর্ট বলে পুল করে ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ার লেগ দিয়ে) আবার টেস্ট ক্রিকেটে আরাধ্য জয়ের মাইলফলকেও পৌঁছে দিয়েছে বাংলাদেশকে।
৩৯ রানে ৮ উইকেট নাকি উইনিং স্ট্রোক? এ দুটোর কোনো একটিকে বেছে নেওয়ার প্রশ্নে অবশ্য তাইজুল জয়সূচক শটটিকেই বাছলেন, ‘চার মেরে জেতানোর ব্যাপারটাই আমাকে বেশি আনন্দ দিয়েছে।’ একই দিনে ব্যাটে-বলে দলের জয়ে অবদান রাখার আনন্দে ভেসে গিয়ে পথ হারানোর আশঙ্কার কথা মুশফিক তাঁকেও বলে থাকলে ভালো। কারণ খ্যাতির জোয়ারে গা ভাসিয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলা এক ক্রিকেটার কিছুদিন আগেও বাংলাদেশ দলে অপরিহার্য ছিলেন। গলি থেকে মহাসড়কে উঠে এসে বিশ্ব রেকর্ডের মালিক বনে যাওয়া সেই অফ স্পিনারের পরিণতি নিশ্চয়ই চোখ এড়াচ্ছে না তাইজুলেরও।
ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক ফার্স্ট ক্লাস টুর্নামেন্ট বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগের (বিসিএল) শেষ আসরে উত্তরাঞ্চলের হয়ে সর্বোচ্চ ৩৭ উইকেট নিয়েই নজর কাড়েন এ তরুণ। সুবাদে বাংলাদেশ ‘এ’ দলের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে সুযোগ পেয়ে যান। সেখানে ৯ উইকেট পাওয়ার পুরস্কার হিসেবে উড়ে যান জাতীয় দলের ক্যারিবীয় সফরেও। সেন্ট ভিনসেন্ট টেস্টে অভিষেকের সময় থেকে তাঁর শ্রম-ঘামের পুরস্কারই এবার তাইজুল পেলেন বলে মনে করেন মুশফিক, ‘গত দুই-তিন মাস ও খুব কষ্ট করেছে। ভেতরে যে ক্ষুধাটা ছিল, সেটাই ওর সাফল্যে ভূমিকা রেখেছে।’
তাইজুল জানাচ্ছেন, সাকিব আল হাসানকে টপকে বাংলাদেশের টেস্ট রেকর্ড গড়া বোলিং পারফরম্যান্সে প্রথম ইনিংসে তেমন কিছু করতে না পারারও যোগ আছে, ‘আগের ইনিংসে খুব একটা ভালো করতে পারিনি। এটা নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। কারণ এটা হলো লড়াই করে টিকে থাকার জায়গা।’ সে লড়াইয়ের ময়দানে ৮ উইকেট নেওয়া পারফরম্যান্সে তাঁর কাছে প্রত্যাশা বেড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। পরের দুই টেস্টেও সাফল্যের জন্য ঢাকার মতো উইকেটই চাই কি না, এমন প্রশ্নে অবশ্য নিজের সোজাসাপ্টা বোলিং দর্শনেই বিশ্বাস রাখলেন এ তরুণ, ‘উইকেট এমনই হোক আর যেমনই হোক, বল ভালো জায়গায় করতে পারাই মূল ব্যাপার।’