ফুলমালাদের মুখে হাসি

৯০ বছরের বৃদ্ধা ফুলমালা বয়সজনিত নানা রোগে ভুগছেন। তবে চোখের সমস্যা আর মাথাব্যথাটা যেন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে। কিন্তু মুন্সীগঞ্জ জেলার দক্ষিণ মহাখালীতে বাস করে এই রোগের চিকিৎসা তিনি কোথায় কিভাবে করাবেন? চিকিৎসার খরচ জোগাড় করাটাও বড় সমস্যা। এমনই সময়ে খবর পেলেন, বলতে গেলে বাড়ির কাছেই সুচিকিৎসা মিলবে। এ জন্য কোনো টাকা-পয়সাও লাগবে না। অবশেষে স্বজনের কাঁধে ভর করে তিনি এলেন হাসপাতালে। নামকরা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপনায় সুচিকিৎসা পেয়ে হাসি ফুটল এই অশীতিপর বৃদ্ধার মুখে।
শুধু ফুলমালা নন, একে একে দুই হাজারের বেশি রোগীকে বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন বসুন্ধরা গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা আদ্-দ্বীন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। ফ্রি স্যাটারডে ক্লিনিকে গতকাল বুধবার তাঁরা দিনভর বিভিন্ন রোগে আক্রান্তদের বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা দেন। শুধু তাই নয়, ব্যবস্থাপত্রের পাশাপাশি বিতরণ করা হয় প্রয়োজনীয় ওষুধ। ছিল ব্লাডব্যাংকের ব্যবস্থাও।
মুন্সীগঞ্জ জেলা শহরের মাঠপাড়ায় কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাবেক কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক হামিদুর রহমান এবং মুক্তিযুদ্ধের সাব-সেক্টর কমান্ডার ফ্লাইট লে. জামাল উদ্দিন চৌধুরী স্মরণে আয়োজিত ফ্রি স্যাটারডে ক্লিনিকে দিনভর এই সেবা দেওয়া হয়। বসুন্ধরা আদ্-দ্বীন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সহযোগিতায় এবং মুন্সীগঞ্জ এপেক্স ক্লাবের পরিচালনায় এই আয়োজনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক সাইফুল হাসান বাদল।
চিকিৎসা ক্যাম্প শুরু হয় গতকাল সকাল ৯টায়। বিকেল ৫টা পর্যন্ত চলার কথা থাকলেও রোগীর ভিড়ের কারণে ক্যাম্পে সেবা কার্যক্রম চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। শুরু থেকেই একসঙ্গে চলতে থাকে বিনা মূল্যে রোগী দেখা, ব্যবস্থাপত্র দেওয়া ও ওষুধ বিতরণ কার্যক্রম। একই সঙ্গে চলে ব্লাডব্যাংকে রক্তদান কর্মসূচি। সেখানে প্রায় এক শ ব্যক্তি রক্তের গ্রুপ করে বিনা মূল্যে। অনেকে আবার স্বেচ্ছায় রক্তদান করে।
মুন্সীগঞ্জ শহর ছাড়াও আশপাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে রোগীরা এখানে আসে চিকিৎসাসেবা নিতে। এদের একজন খাসকান্দি গ্রামের সানোয়ারা বেগম (৪০)। বৃদ্ধা ফুলমালার মতো তিনিও বিনা মূল্যে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ও ওষুধ পেয়ে আয়োজকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। দেওভোগের মাফিয়া খাতুন (৭০) এসেছিলেন চোখের চিকিৎসা নিতে। ব্যবস্থাপত্র ও বিনা মূল্যের ওষুধ হাতে পেয়ে নিজের সন্তোষ প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি প্রায় কেঁদে ফেলেন।
ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্প আয়োজনের উদ্যোক্তা অ্যাডভোকেট আর্শেদ উদ্দিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসক ছাড়াও বক্তব্য দেন প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মেজর রেজাউল করিম, সাবেক প্রধান বন সংরক্ষক মো. নুরুজ্জামান, বসুন্ধরা আদ্-দ্বীন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইনচার্জ ডা. ওয়াহিদা হাসিন, হাসপাতালটির বিভাগীয় প্রধান (চক্ষু) অধ্যাপক রুহুল আমিন, অভিজিৎ দাস ববি, অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম পল্টু, মুন্সীগঞ্জ এপেক্স ক্লাবের সভাপতি মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল প্রমুখ। সিভিল সার্জন ডা. শহিদুল ইসলাম চিকিৎসা ক্যাম্প পরিদর্শন করে সন্তোষ প্রকাশ করেন।
আর্শেদ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, অধ্যাপক হামিদুর রহমান ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট জামাল উদ্দিন চৌধুরী জাতির জন্য অনেক কিছু করেছেন। এই ক্লিনিক চালু করার উদ্দেশ্য কিছুটা হলেও তাঁদের ঋণ পরিশোধের চেষ্টা।
জেলা প্রশাসক ফ্রি স্যাটারডে ক্লিনিকের জন্য ৫০ হাজার টাকা অনুদান ঘোষণা করে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে দেশ ও জাতির জন্য কাজ করেছেন প্রয়াত অধ্যাপক হামিদুর রহমান ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট জামাল উদ্দিন চৌধুরী। এই মহান ব্যক্তিদের স্মরণে রাখা আমাদের নৈতিক কর্তব্য।’
এই ফ্রি স্যাটারডে ক্লিনিককে এরই মধ্যে মুন্সীগঞ্জ এপেক্স ক্লাবের একটি স্থায়ী সেবা হিসেবে ঘোষণা করেন আন্তর্জাতিক সেবা সংগঠনটির জাতীয় সভাপতি অ্যাডভোকেট সৈয়দ নুরুর রহমান। মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল বলেন, গুণীদের সম্মান করা গেলে সেখানে গুণীর জন্ম হয়। তাই এই দুই মহান ব্যক্তি স্মরণে এপেক্স ক্লাব ক্লিনিকটি সচল রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে। বসুন্ধরা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা দেওয়ায় কর্তৃপক্ষকে তিনি ধন্যবাদ জানান।
বসুন্ধরা আদ্-দ্বীন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ও ইনচার্জ ডা. ওয়াহিদা হাসিন বলেন, ‘মানবতার সেবায় আত্মনিয়োগ করাটা নৈতিক দায়িত্ব। এখানে এত মানুষকে সেবা দিতে পেরে ভালো লাগছে। বসুন্ধরা গ্রুপ এই দেশ ও দেশের মানুষকে সেবা ও সহযোগিতা করতে সব সময়ই কিছু না কিছু করার চেষ্টা করে। সেই প্রয়াস থেকেই বসুন্ধরা আদ্-দ্বীন মেডিক্যাল কলেজের মাধ্যমে স্বল্প মূল্যে দরিদ্র রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিনা মূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ বিতরণ করে চলেছে।’
ফ্রি ক্লিনিকে ডা. ওয়াহিদা হাসিন ছাড়াও চক্ষু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রুহুল আমিন, গাইনি বিভাগের ডা. নাসরিন, মেডিসিন বিভাগের ডা. দেওয়ান আল আমিন, শিশু বিভাগের ডা. এ টি এম সাইফুজ্জামান ও চক্ষু বিভাগের ডা. সাফায়েত জামিলের তত্ত্বাবধানে দরিদ্র রোগীদের বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়।